স্বাধীনতা প্রতিটি মানুষের জন্মগত অধিকার।এটি একটি সর্বজনীন মূল্যবোধ যা সারা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। এই স্বাধীনতা শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা পর্যন্ত সবার কাম্য। মায়ের কোলের যে শিশু, সেও স্বাধীনভাবে তার হাত-পা নাড়া-চাড়া করতে চায়; একটু বড় হলে নিজের মতো করে হামাগুড়ি দিতে চায়; হাঁটতে ও দৌড়াতে চায় । তার স্বাধীনতা ব্যাহত হলে সে ছটফট করে, কান্নাকাটি করে।এসব থেকে মুক্তি পেতে পাঁচ আগস্ট স্বৈরাচারী শাসনের হাত থেকে মুক্তি এনে দিয়েছে ছাত্র জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। এখন প্রশ্ন জাগে, এই রক্তমাখা অভ্যুত্থানের পরও মানুষ কেন সরাসরি কথা বলতে পারছে না। এটা কি সত্য? সাধারণ চোখে দেখলে মনে হবে সত্য, আবার সত্য নয়। মানুষ মুক্তমনে কথা বলতে পারছে, আবার ভয়ও কাজ করছে মনে। মতপ্রকাশে বাধা না থাকলেও কোথাও কোথাও যেন অদৃশ্য দেয়াল রয়েই গেছে। যেমন প্রশ্ন করতে পারছি না, প্রায় ষোল বছরের ফ্যাসিবাদের শিরোমণিকে কেন সসম্মানে দেশত্যাগ করতে দেওয়া হলো? কোন জাদুমন্ত্রবলে ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রায় সব প্রভাবশালী সীমান্ত পেরিয়ে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে যেতে পারল? শুধু জুলাই-আগস্টে শত শত নাগরিক হত্যার অভিযোগেই তো তাদের কারাগারে থাকার কথা ছিল! এসব প্রশ্নের কি কোনো জবাব আছে? না, আপাতত নেই। যেমন জবাব নেই আয়নাঘর নিয়ে অনেক প্রশ্নের। আয়না ঘরের কথা জেনেছি আমরা। নির্যাতনের বর্ণনাও শুনেছি ফিরে আসা অনেকজনের মুখে। কিন্তু এটা জানতে পারছি না, সেই আয়নাঘরের মালিক কারা? কাদের নির্দেশে মানুষকে আয়নাঘরে নেওয়া হতো? এসব প্রশ্ন আমরা করতে পারি না। এক ধরনের ভয়, শঙ্কা আমাদের শিরদাঁড়া বেয়ে নিচের দিকে নেমে যায়।
তাহলে কি, কোথাও কোথাও একটা অদৃশ্য দেয়াল রয়ে যাচ্ছে কিংবা রয়ে গেছে। কিন্ত সেটা পার হওয়া যাচ্ছে না কেন? সে দেয়াল কারা তুলছে? সরকারের পক্ষ থেকে, নাকি সমাজ-সংসারের পক্ষ থেকে। নাকি রাজনৈতিক দলগুলোর তরফে থেকে যাচ্ছে এক অলিখিত না-বোধক ইশারা? কিংবা বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের দূরদর্শী প্রজ্ঞার আলোকে আসছে চাপ? আবার এটাও হতে পারে, যে জ্ঞান আর যুক্তির কাঠামোর মধ্যে আমাদের দেড় দশকের বসবাস, সেই খোলস আমরা ভাঙতে পারিনি। এটা ঠিক, চিন্তা করার স্বাধীনতা নিজেকেই অর্জন করতে হবে। আমাদের চিন্তা, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, আমাদের কল্পনার আকাশ তো অন্য কেউ মুক্ত করে দেবে না! এটাও সত্য, আমাদের সংবিধানের উনচল্লিশ নম্বর অনুচ্ছেদে চিন্তার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের চিন্তাভাবনার প্রচলিত ধ্যান-কাঠামোর ভেতর থেকে মুক্ত করার কাজটি করব কীভাবে? এই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। আমরা দেখি না; শুধু শুনি। শুনে শুনে জ্ঞান অর্জন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রবাহ হয়ে উঠেছে। এই প্রবাহ যে অর্ধসত্য-সেটা আমরা কখনোই ভেবে দেখি না। ভাবনাহীন জাতিসত্তা রাজনৈতিক নেতাদের মিথ্যাকেও সত্য বলে মানে। আবার সত্যকে মিথ্যা বলে মনে করে। কারণ, তার দলীয় দৃষ্টি ও চেতনা তাকে শেখায়-নেতার কথাই সত্য। এসব কথা আমরা কোনো রাজনৈতিক দলকে বলতে পারব? বলতে গেলে হেলমেট বাহিনী তেড়ে আসবে না তো? বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের শায়েস্তা করতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, ওদের শায়েস্তা করতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট। নেতার এই হুঙ্কারের পর হেলমেট বাহিনী রাস্তায় নেমে ছাত্র-জনতাকে রক্তাক্ত করতে থাকে। পরে অবশ্য ছাত্র-জনতার তীব্র ও বিপুল প্রতিরোধে তারা পিছু হটে যায়। এই ঘটনার জন্য হেলমেট বাহিনী দায়ী, নাকি ওবায়দুল কাদের দায়ী?
এই সত্যগুলো কি আওয়ামী লীগ নেতারা ক্ষমতাচ্যুতির পরও প্রকাশ্যে সমালোচনা করতে পারবেন? মানুষ জানে, শেখ হাসিনার শাসনামলে প্রকাশ্যে সত্য বলা কঠিন ছিল। গুম কিংবা খুন-যে কোনোভাবে সত্য চাপা দিতে তারা সিদ্ধহস্ত ছিল। এই ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধেই ছাত্র-জনতা রুখে দাঁড়িয়েছে, প্রাণ দিয়েছে। এতকিছু পর এখনও কি আমরা সব সত্য বলতে পারছি? সমাজের বিভিন্ন স্তরে এখনও কি ফ্যাসিবাদ রয়ে গেছে না? আর কিছু না হোক, অন্ধভাবে নিজেকে সঁপে দেওয়ার রাজনৈতিক সংস্কৃতি কি আমাদের চিন্তা ও বাকস্বাধীনতা হরণ করে চলছে না? এই বাধা অপসারণে রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা জরুরি। সেটা কীভাবে করব?বর্তমানে প্রকাশ্য ও ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোকে চিন্তার স্বাধীনতা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নিতে হবে।সে স্বাধীনতা দিতে হলে দলের ভেতরে গণতান্ত্রিক রীতি ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। আর সেটা তৃণমূলের রাজনৈতিক কর্মীদের মাধ্যমে, ভোটের ভেতর দিয়ে নেতৃত্ব পরিবর্তনের কাঠামোগত ব্যবস্থায় সম্ভব করে তোলা। কর্মীদের মতপ্রকাশকে অবারিত করতে হবে। সমালোচনা ও আত্মসমালোচনার দুয়ার উন্মুক্ত করতে হবে। নেতৃত্বে যদি শিক্ষিত ও কর্মদক্ষ নেতা আসেন অবশ্যই নির্বাচনের ভেতর দিয়ে, তাহলেই শুধু এ দেশে সত্যিকারের গণতন্ত্র কায়েম হবে। চিন্তার স্বাধীনতা খোদ রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যও স্বাস্থ্যকর ও স্বস্তিকর। কর্মীদের মনে সৎসাহস ও চিন্তা করার অধিকার দিলে তারা নেতাদের দোষত্রুটি ও দলীয় কর্মপরিকল্পার ভুলভ্রান্তির সমালোচনা করে দলকে সঠিক পথে রাখতে পারে। দলীয় কাজ ও পরিকল্পনার সমালোচনার পাশাপাশি আত্মসমালাচনা করতে দিলে একজন নেতা-নেত্রীর সঙ্গে কর্মীদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় না। ফলে কর্তৃত্বের শাসন, ফ্যাসিবাদের অঙ্কুরিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে না।
আমাদের নেতানেত্রী ও কর্মীরা দেশভাবনা থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন। এই বিচ্ছিন্নতাবোধ থেকেই নিজের জীবন নিয়ে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ত্যাগ করেছেন। যদি তিনি কর্মী-বিচ্ছিন্ন না হতেন, তাহলে ক্ষমতা গেলেও দেশ ও দল তাঁর সঙ্গে থাকত। তাঁর এই পরিণতি কি আওয়ামী লীগের কর্মীরা মেনে নিতে পারছেন? নাকি পারছেন না? সেই সত্য জানার পরিবেশ কি আমরা এখনও তৈরি করতে পেরেছি? নাকি এখনও কিছু সত্য গুমরে কাঁদছে? সেই গুমরানো কান্না কি আজকের শাসকদের কানে পৌঁছাচ্ছে? প্রজাতন্ত্রের নামে মানুষকে প্রজা বানিয়ে রাখার ব্যবস্থা এতো শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে, মানুষ ভুলেই গিয়েছিল; সে স্বাধীন। স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও স্বাধীন ব্যক্তির মর্যাদা পায় না মানুষ। বলা হতো বিচার বিভাগ স্বাধীন, পুলিশ স্বাধীন, প্রশাসন স্বাধীন আর মানুষ ভাবে শুধু সে-ই পরাধীন। ফলাও করে বলা হয়, সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। কিন্তু কার্যত ক্ষমতার যাঁতাকলে পিষ্ট মানুষ মালিক হিসেবে দেখেছে ক্ষমতাসীন-দেরকে।এমন এক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হয়েছিল,যেখানে মন্ত্রী-এমপি-আমলা-পুলিশ সবাইকে একজন বিশেষ ব্যক্তির কাছেই কেবল জবাবদিহি করতে হতো। আর সেই মহান ব্যক্তি ছিলেন সমস্ত জবাবদিহির ঊর্ধ্বে। এর অবসান চেয়েছিল ছাত্র-জনতা। ছাত্র-শ্রমিক-জনতা ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ-আন্দোলনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে নামাতে চাইলেও বিশেষ কাউকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য রাজপথে নামেনি। সরকারের প্রতি ক্ষোভ থেকে জনগণ রাজপথে নেমে এসেছে তাদের সঙ্গে। তারা কাউকে ক্ষমতায় বসাতে চায়নি বরং শাসনব্যবস্থার সংস্কার চেয়েছে। ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় ছাত্ররা রাজপথে লিখেছিল-রাষ্ট্র সংস্কার চলছে, সে সময় হেলমেট বাহিনী দিয়ে তা দমন করা হয়েছিল; কিন্তু তাদের সেই কথা মানুষের বুকে ঠাঁই করে নিয়েছিল।
এবারের আন্দোলনেও তারা বারবার সংস্কারের কথা বলেছে। ছাত্রদের এই দাবির সঙ্গে দেশের সচেতন মহল দাবি তুলেছে। কিন্তু কথা হলো-এসব সংস্কার করবে কে? সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা জনগণের আছে কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা পালন করতে হবে। জনপ্রতিনিধি যারা হয়ে থাকেন তারা যদি জনআকাঙ্ক্ষা ধারণ না করেন বা জন আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে চলতে থাকেন; তা হলে মানুষ প্রতারিত বোধ করবেন আবার। যদি ধনীদের দ্বারা ধনীদের প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়, তা হলে ধনীদের স্বার্থ রক্ষা করবে-এটাই তো স্বাভাবিক। যদি ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা হয়, তা হলে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখবে। সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি না থাকলে সাধারণ মানুষের কথা কে বলবে? সমাজের নানা বিষয়ে সংস্কার, পরিবর্তন, বা আমূল পরিবর্তন অর্থাৎ বিপ্লবের স্বপ্ন তুলে ধরে রাজনৈতিক দলগুলো। তারা পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে, প্রস্তাব দেয়, জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে, আন্দোলনে নামে। ফলে জনগণের মনন জগতেও পরিবর্তন ঘটে। মানুষ তাই চায় আরও গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ। অতীতের অন্ধকার নয়, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে চায় মানুষ। আর এই সময়টাকে কাজে লাগিয়ে যদি আমরা আমাদের জীবনের মুহূর্তগুলোকে সুন্দর করে সাজাতে না পারি তাহলে ভবিষ্যৎ যেমন অন্ধকার থাকবে তেমনি অতীতও হয়ে যাবে অন্ধকার। কারণ অতীত সময়টাকে আমরা আর ফিরে পাবো না।ভবিষ্যতে পাবো কিনা তা জানা নেই।তাই বর্তমানকে প্রাধান্য দিয়ে অতীতকে শিক্ষা হিসেবে গ্রহণ করে ভবিষ্যত সুন্দর করে তোলার প্রয়াস রাখলে সবকিছুই সুন্দর হবে।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য।
আমার বার্তা/জেএইচ