বাংলাদেশের মানুষ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশীদারিত্ব চেয়েছিল। আমাদের জনগণ একটি ন্যায্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে, যার জন্য আমাদের নতুন প্রজন্ম জীবন উৎসর্গ করেছিল। ছাত্র ও যুব সমাজের আন্দোলন প্রথমদিকে মূলত বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন হলেও পর্যায়ক্রমে তা গণআন্দোলনে রূপ নেয় বলে উল্লেখ করেন ড.মুহাম্মদ ইউনূস।তার ভাষ্য, এই গণআন্দোলন রাজনৈতিক অধিকার ও উন্নয়নের সুবিধা বঞ্চিত দেশের আপামর জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। উদারনীতি, বহুত্ববাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার উপর মানুষের গভীর বিশ্বাস থেকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয়। ১৯৭১ সালে যে মূল্যবোধকে বুকে ধারণ করে আমাদের গণমানুষ যুদ্ধ করেছিল, সেই মূল্যবোধকে বহু বছর পরে আমাদের ছাত্র জনতা নতুনভাবে দেখতে শিখিয়েছে। ছাত্রজনতা তাদের অদম্য সংকল্প ও প্রত্যয়ের মাধ্যমে একটি স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা থেকে আমাদের মুক্তি এনে দিয়েছে। দেশের বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, সকল রাজনৈতিক দল স্বাধীন ভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারছে। মানুষের মৌলিক অধিকারকে সমুন্নত ও সুরক্ষিত রাখতে কাজ করেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আমাদের দেশের মানুষ মুক্তভাবে কথা বলবে, ভয়-ভীতি ছাড়া সমাবেশ করবে, তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে-এটাই আমাদের প্রত্যাশা। এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার সকল পর্যায়ে সুশাসন ফিরিয়ে আনাই হোক অন্তর্বর্তী সরকারের অভীষ্ট লক্ষ্য। আগামী দিনগুলোতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষকে মুক্তি ও ন্যায়বিচারের পক্ষে দাঁড়াতে প্রেরণা যুগিয়ে যাক ড.মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার। একজন দূরদর্শী ও পরিবর্তনকারী হিসেবে ড. ইউনূসের খ্যাতি তাঁর বর্তমান ভূমিকার আগে থেকে অর্জিত। দারিদ্র্য বিমোচনে তাঁর যুগান্তকারী কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ, বিশেষ করে গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে, তাঁকে ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়।
তবে তাঁর প্রভাব এই মর্যাদাপূর্ণ অর্জনের বাইরে আরও বিস্তৃত। ক্ষুদ্রঋণ এবং সামাজিক ব্যবসার ওপর তাঁর তত্ত্ব বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে অধ্যয়ন ও প্রয়োগ করা হয়েছে। তাঁর বই বিশ্বব্যাপী পরিবর্তন-নির্মাতাদের অনুপ্রাণিত করে চলেছে। বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ দিয়ে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি দিয়েছে এবং জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তাঁর পরামর্শ নিয়ে আসছে। তাঁর গ্রহণযোগ্যতা এবং সম্মান বিস্তৃত মহাদেশ এশিয়া থেকে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আফ্রিকা এবং আমেরিকা আজকের অখন্ডিত বিশ্বে একটি বিরল বৈশ্বিক ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস যখন দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন তখন বিশ্বের সাড়া ছিল দ্রুত এবং ইতিবাচক। ইউরোপীয় ইউনিয়ন,মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্বব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিভিন্ন বৈশ্বিক সংস্থা তাদের সমর্থন জানিয়েছে। এটি বাংলাদেশের পূর্ববর্তী বৈশ্বিক ধারণার সঙ্গে তীব্র বৈপরীত্য চিহ্নিত করে, যেখানে শাসন, গণতন্ত্র এবং উন্নয়ন নিয়ে উদ্বেগ প্রায়ই সংশয় ও সমালোচনার সম্মুখীন হয়। ড.মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বিশ্ব একটি গতিশীল ও প্রগতিশীল দেশে বাংলাদেশের রূপান্তরের নতুন আশা দেখছে। সুতরাং বাংলাদেশ তার ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে, যার নেতৃত্বে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এখন তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। যাঁর উদ্ভাবিত ক্ষুদ্রঋণ ও সামাজিক ব্যবসা মডেল বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষকে ক্ষমতায়ন করেছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস কেবল একজন নেতাই নন, আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত একজন দূরদর্শী, যাঁর তত্ত্ব, চিন্তা ও ধারণা বইয়ের পাতা থেকে মানুষের ঘরে পৌঁছে গেছে; অর্থনীতিকে তিনি নতুন আকার দিয়েছেন এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমানকে উন্নীত করেছেন।
সেজন্যই তিনি অর্থনীতিবিদ হওয়া সত্ত্বেও শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার বিরল সম্মান অর্জন করে বাংলাদেশকে গৌরবান্বিত করেছেন। একজন বৈশ্বিক চিন্তাধারার নেতা থেকে দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে তাঁর উত্তরণ জাতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ চিহ্নিত করে, যেটি একাধিক খাতে প্রত্যাশিত পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দেয়।গত ১৫ বছর তাঁকে নানাভাবে হয়রানি করা হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে ১৭২টি মামলা দিয়ে। এজন্য দেশের বাইরে আমাদের নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। যে দেশে জ্ঞানী ব্যক্তির সমাদর নেই সে দেশ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মহলে নেতিবাচক ধারণা জন্মায়। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক গতিশীলতা, তৎকালীন সরকার এবং কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির প্রতিহিংসার কারণে ড. ইউনূসের বৈশ্বিক অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে সুবিধা লাভ থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হয়েছে।এর জন্য যারা দায়ী, বিশেষ করে সরকারপ্রধানের যারা ঘনিষ্ঠ এবং ড.মুহাম্মদ ইউনূস বিরোধী তাদের চিহ্নিত করে মুখোশ উন্মোচন করা উচিত।কারণ,এর ফলে দেশের সমূহ ক্ষতি সাধিত হয়েছে। এখন প্রায় দুই দশক পরে জোয়ারের মোড় ঘুরেছে।দেশের তরুণদের আহ্বানে ড.মুহাম্মদ ইউনূস চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করে জাতির নেতৃত্বে ফিরে এসেছেন। তাঁর নেতৃত্ব দেশটির জন্য তাঁর চিন্তা-ভাবনাকে পুঁজি করে সংস্কার বাস্তবায়নের দ্বিতীয় সুযোগের প্রতিনিধিত্ব করে, যা বাংলাদেশকে টেকসই উন্নয়ন এবং বিশ্বব্যাপী বিশিষ্টতার দিকে নিয়ে যাবে। দেশের ক্রমবর্ধমান যুব জনসংখ্যার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে, যদি তাদের সুযোগ দেওয়া হয়। চাকরি সৃষ্টি এবং উদ্যোক্তার ওপর ড. ইউনূসের ফোকাস তাঁর সামাজিক ব্যবসা মডেল দ্বারা অনুপ্রাণিত। যদি তা দেশের জনসংখ্যাগত লভ্যাংশকে কাজে লাগাতে সচেষ্ট থাকে, দারিদ্র্য হ্রাস করে এবং অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা বৃদ্ধি করবে।
ড.মুহাম্মদ ইউনূসের দৃষ্টিভঙ্গি অর্থনৈতিক উন্নয়নের বাইরেও প্রসারিত। তিনি দীর্ঘদিন ধরে এমন একটি সরকারের লক্ষ্যে প্রচার করে আসছেন যা তার জনগণের সেবা করে, স্বচ্ছতা, দক্ষতা এবং জবাবদিহি বৃদ্ধি করে। সুশাসন এবং একটি জনবান্ধব পুলিশ বাহিনীকে উন্নীত করার মাধ্যমে তিনি রাষ্ট্র এবং এর নাগরিকদের মধ্যে আস্থা পুনর্নির্মাণে অবদান রাখতে পারেন। গণতান্ত্রিক নীতিতে দৃঢ় বিশ্বাসী ড.মুহাম্মদ ইউনূস এমন একটি বাংলাদেশের রূপান্তর ঘটাবেন যেখানে গণতন্ত্রের বিকাশ হবে, অপরাজনীতির শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হবে দেশের মানুষ। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সকল ধর্মীয় ও জাতিগত সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতির পক্ষেও তাঁর অবস্থান সুদৃঢ় থাকবে।দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদের একটি হলো এর বিশাল প্রবাসী জনবল।দক্ষ অভিবাসনে- র ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে এবং বিদেশে কর্মীদের দক্ষতার মাধ্যমে যোগ্য করে গড়ে তোলার মাধ্যমে কর্মীবান্ধব নীতির প্রচারের মাধ্যমে ড. মুহাম্মদ ইউনুস উল্লেখযোগ্য বৈদেশিক মুদ্রা আনয়নে সচেষ্ট থাকবেন, যা দেশের উন্নয়নে প্রভূত ভূমিকা রাখবে। জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতায় ড.মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্ব, টেকসই কৃষি চর্চার প্রচার থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়নের পক্ষে সমর্থন,জাতির ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।গ্লোবাল স্টেজ এবং আঞ্চলিক নেতৃত্ব অভ্যন্তরীণ সংস্কারের বাইরেও ড.মুহাম্মদ ইউনূসের বিশ্বমঞ্চে দেশের অবস্থানকে উন্নীত করার ক্ষমতা রয়েছে।একটি শক্তিশালী ও আরও কার্যকর দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) জন্য তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের আদলে তৈরি, আঞ্চলিক সহযোগিতা ও উন্নয়নকে উৎসাহিত করা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সমর্থনে ড.মুহাম্মদ ইউনূস দেশকে দক্ষিণ এশিয়ায় একটি নেতা হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছেন, শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকে নয়, বরং একটি শান্তিপ্রিয়, অসাম্প্রদায়িক জাতি হিসেবে বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে।
একটি সমাজে ন্যায়বিচার, সাম্য এবং মর্যাদা সামগ্রিক বিকাশ ও প্রগতির জন্য অপরিহার্য। এই নীতিগুলো সমুন্নত রাখতে গণতন্ত্র, সাম্য ও ন্যায়বিচারকে যে কোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে। ড.ইউনূস সামনের চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে অবগত। দেশকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে কিভাবে কাজ করতে হবে তা তিনি ভালো করেই জানেন। দেশকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য তাঁর অদম্য মিশনে আমাদের সবার সহযোগিতা ও সমর্থন রয়েছে। তারা যদি প্রয়োজনীয় সহযোগিতা না ও করেন, তাঁর কোনো প্রচেষ্টাকে যেন দুর্বল করার চেষ্টা করতে না পারেন বা কোনোরূপ ষড়যন্ত্র না করতে পারেন, সেজন্য তাঁকে সতর্ক থাকতে হবে।আমাদের মনে রাখতেই হবে,বাংলাদেশি তারুণ্যের এই নতুন পরিচয় এক নতুন ব্র্যান্ডিং হিসেবে উঠে এসেছে। তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। শিক্ষার্থী ও দেশের মানুষের ঐক্যের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে যে ঐক্য ও ত্যাগ প্রবল স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছে সে ঐক্যই পারে সব ষড়যন্ত্র ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে অর্ন্তবর্তী সরকারকে সাফল্যের সর্বোচ্চ সোপানে পৌঁছে দিতে। দেশের মুক্তিকামী মানুষ এই সরকারের সাফল্য প্রত্যাশা করে।যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধভাবে সরকারের পাশে থাকতেও দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ। সুতরাং দেশের জনগণের আত্মত্যাগের বিষয় বিবেচনায় রেখেই সুশাসনের জন্য মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে অন্তর্বর্তী সরকারকে দক্ষতার সাথে এগিয়ে যেতে হবে। কারণ স্বচ্ছতা হলো এমন একটি বিমূর্ত ধারণা যা দ্বারা মানুষ উপলব্ধি করতে পারে যে কোন কর্মকান্ড কতটুকু নীতি সংগত ও বৈধ। এক কথায় স্বচ্ছতা হলো স্পষ্টতা। সরকারি কর্মকান্ডে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার উপর সুশাসন নির্ভর করে। তাই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে যখন সরকার তাদের কর্মকান্ড, নীতিমালা, সিদ্ধান্ত জনগণকে অবহিত করতে পারবে। তাই বলা যায় জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা ছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য।
আমার বার্তা/এমই