রোহিঙ্গা সমস্যা মানবিক সংকটের পাশাপাশি একটি রাজনৈতিক সমস্যা এবং এই সংকটের সমাধান রাজনৈতিকভাবেই হতে হবে। চলমান সংকটের শুরু থেকে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া স্বত্বেও রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান আলোর মুখ দেখছে না। নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার কারনে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নেয়া সংকটের সমাধানের উদ্যোগ বাস্তবায়নে বাধার সৃষ্টি করছে। বিশ্বব্যাপী চলমান নানা সংঘাতের কারনে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে মনোযোগ কমে আসছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আগ্রহ কমে যাওয়াতে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হচ্ছে। ত্রাণ সহায়তা কমে আসায় রোহিঙ্গাদের জন্য নেয়া প্রকল্পগুলোর কার্যকারিতা হ্রাস পাচ্ছে। ২০২৫ সালের জেআরপির আওতায় ৯৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার আর্থিক সহায়তা চাওয়া হয়েছিল, যার অর্ধেকও এখন পর্যন্ত পাওয়া যায় নাই। বর্তমানে ডব্লিউএফপি’র তথ্য অনুসারে জরুরি অর্থসহায়তা না পেলে আগামী ৩০ নভেম্বরের পর বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গার জন্য খাদ্যসহায়তা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাবে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক দাতাদের কাছে আবেদন জানিয়েছে যাতে তারা তাদের অঙ্গীকার বাড়ায় এবং ২০২৫-২৬ সালের জেআরপি’র তহবিল ঘাটতি পূরণ করে। আঞ্চলিক দেশগুলোও এই সমস্যা সমাধানে সক্রিয় ভুমিকা পালন করছে না। কার্যকরী সমাধানের জন্য সামনের দিনগুলোতে এসব উদ্যোগের পাশাপাশি আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকেও সম্পৃক্ত করতে হবে। একই সাথে জাতীয় ঐক্য নিশ্চিত করে এই সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের পদক্ষেপও নিতে হবে।
বর্তমানে বাংলাদেশে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। তহবিল সংকটের কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের তিন হাজার লার্নিং সেন্টার বন্ধ হয়ে গেছে এতে চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা শিশু শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ক্যাম্পগুলোতে ছয় লাখ কর্মক্ষম তরুণ ও যুবকের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু না হলে তাদের কিছু অংশ অপরাধে জড়িয়ে পড়বে অনেকে পাচারের শিকার হবে। বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের একাংশ নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। কিছু কিছু রোহিঙ্গার অপরাধে জড়ানোর কারনে মাদক, অস্ত্র, ও মানব পাচার বেড়ে যাচ্ছে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা বিভিন্ন সময়ে সংগঠিত অপরাধ নিয়ন্ত্রণে মামলা দায়ের করে ও আসামীদেরকে গ্রেফতার করার চেষ্টা চালায়। খুন, মাদক পাচার, অপহরণ, অস্ত্র পাচার, ধর্ষণ ইত্যাদি নানা ধরনের অপরাধের কারনে দায়েরকৃত মামলার আসামীদের সবাইকে ক্যাম্পের জনঘনত্বের কারনে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়না। তবে ক্যাম্পের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের কার্যক্রম চলমান রেখেছে।
রাখাইনে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের উপর আরাকান আর্মির নির্যাতন বন্ধে আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক কোন কার্যকরী উদ্যোগ না নেয়ায় রোহিঙ্গারা নতুন করে আবার দেশত্যাগে বাধ্য হচ্ছে। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রহণ যোগ্যতা বাড়াতে আরাকান আর্মির সাথে আলোচনা চালানোর পাশাপাশি এই সংকটের রাজনৈতিক সমাধান নিশ্চিত করতে হবে। এই সংকটের কারনে বাংলাদেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মাদক, মানব পাচার, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা এবং জেলেদের অপহরণ বন্ধে উদ্যোগ নিতে হবে। ত্রাণ সহায়তা চলমান রাখতে কার্যকরী উদ্যোগ নিয়ে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও সংযোগ বৃদ্ধি করতে ব্যবস্থা নিতে হবে। রোহিঙ্গাদের উপর চালানো নৃশংসতা ও গণহত্যার জন্য দায়ীদের বিচার ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা গেলে এই সংকটের পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব হবে। একই সাথে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও জাতিগত পরিচয়, উপযুক্ত শিক্ষা ও পুনর্বাসনের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। মিয়ানমারে নাগরিকত্ব স্বীকৃতি ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ছাড়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব হবে না। এই সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রোহিঙ্গাদের টিকে থাকার সংগ্রাম, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতাকে তুলে ধরতে হবে।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তিনটি সম্মেলনের আয়োজন করছে। আগস্ট মাসে বাংলাদেশের কক্সবাজারে সম্মেলনের মাধ্যমে তা শুরু হয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের ৮০তম অধিবেশনে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূস রোহিঙ্গা ইস্যুকে গুরুত্ব দিয়ে এই সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি সংকট সমাধানে দায়িত্বশীলদের জানান যে, এই সংকটে সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী রোহিঙ্গারা, আর তাদের পরেই বৃহত্তম ভুক্তভোগী হলো বাংলাদেশ। বাংলাদেশ একটি দায়িত্বশীল প্রতিবেশী এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্বশীল সদস্য হিসেবে মানবিক দায়িত্ব পালন করে আসছে। এই ধারাবাহিকতায় সবশেষ সম্মেলন ডিসেম্বর মাসে কাতারে অনুষ্ঠিত হবে। এর ফলে এই সমস্যা আন্তর্জাতিক ভাবে গুরুত্ব পাবে ও সহায়তা বাড়বে বলে আশা করা যাচ্ছে।
প্রত্যাবাসন যত দেরি হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের প্রতি স্থানীয় জনগোষ্ঠী সহনশীলতা ততই কমে আসছে। সহায়তার পরিমাণ কমে আসায় ওই অঞ্চলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার ঝুঁকিও বাড়ছে। রোহিঙ্গা সংকট সেবা, অবকাঠামো এবং সামাজিক জীবনে বড় চাপ সৃষ্টি করেছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ‘ইনক্লুসিভ সার্ভিসেস অ্যান্ড অপরচুনিটিস ফর হোস্ট কমিউনিটি অ্যান্ড ডিসপ্লেসড রোহিঙ্গা পপুলেশন এবং হোস্ট অ্যান্ড রোহিঙ্গা এনহ্যান্সমেন্ট অব লাইভস প্রকল্প চালু হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ৭০ কোটি ডলারের এই প্রকল্প দুটি বাস্তবায়ন করবে। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের মতে বিশ্বব্যাংকের এই প্রকল্পগুলো ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সাত দফা প্রস্তাব তুলে ধরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও কার্যকর ভূমিকা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। অধ্যাপক ইউনূস মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ও আরাকান আর্মিকে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও জীবিকা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকাকে অপরিহার্য উল্লেখ করে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আসিয়ান ও প্রতিবেশী দেশগুলোকে আরও সক্রিয়ভাবে রাখাইন ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে মানব পাচার, মাদক চোরাচালান ও ক্ষুদ্র অস্ত্রের অবৈধ ব্যবসার মতো আন্তসীমান্ত অপরাধ দমনেও উদ্যোগী হতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যা ও এর টেকসই সমাধানকে বৈশ্বিক এজেন্ডায় রাখার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন যে,রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত এই সংকট সমাধানে বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থনের প্রয়োজন হবে।
বাংলাদেশে অবস্থিত বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক মিশন রোহিঙ্গা সংকটের দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই সমাধানের ওপর জোর দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়ে সংকটের দীর্ঘমেয়াদি সমাধান এবং এর মূল কারণগুলো দূর করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তারা রোহিঙ্গাদের জন্য টেকসই সমাধানের লক্ষ্যে রোহিঙ্গাদের আত্মনির্ভরশীলতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করা এবং রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং রোহিঙ্গা ইস্যু বিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভের দপ্তর যৌথভাবে ‘টেক অ্যাওয়ে টু দ্য হাই-লেভেল কনফারেন্স অন দ্য রোহিঙ্গা সিচুয়েশন’ শীর্ষক সম্মেলনের আয়োজন করে। এতে জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে সক্রিয় সব স্টেকহোল্ডারসহ অন্তত ৪০টি দেশের প্রতিনিধি অংশ নেয়। সম্মেলনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য কার্যকর রূপরেখা প্রণয়নের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ফান্ড গঠন, গণহত্যার বিচার, খাদ্য ও মানবিক সহায়তা এবং রোহিঙ্গাদের মানসিক শক্তি ও মনোবল বৃদ্ধির মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে জোর দেওয়া হয়।
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মানবিক সহায়তা ও তহবিল সংকট, রাখাইন রাজ্যে আস্থা তৈরির পদক্ষেপ ও প্রত্যাবাসন, ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতা, এবং টেকসই সমাধানের দীর্ঘমেয়াদি কৌশল সম্পর্কে পদক্ষেপ নেয়ার কথা রয়েছে। সহায়তা কমে গেলে ভয়াবহ মানবিক সংকট তৈরি হতে পারে। তাই সংকট সমাধানে বিদ্যমান সহায়তাকারীদের পাশাপাশি নতুন উৎস থেকেও আর্থিক সহায়তা পাওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে এই সমস্যা ও এর চলমান কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা হলে ও মূল সংকটের কেন্দ্র মিয়ানমারের রাখাইনে এর সমাধানে কোন উদ্যোগ বা অগ্রগতি নেই। আন্তর্জাতিক অঙ্গন ও মিডিয়াতে রোহিঙ্গাদের কার্যক্রম প্রচারিত হলেও মিয়ানমার সরকার ও আরাকান আর্মির এ সংক্রান্ত ভুমিকা নিয়ে কোন প্রচারনা নেই। বাংলাদেশেও এই সমস্যার বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন মিডিয়া, সুশীল সমাজ ও অন্যান্য পর্যায়ে তৎপরতা ও প্রচার বাড়াতে হবে। নিয়মিত এই সংকটের বিষয়ে আলোকপাত ও অগ্রগতির তথ্য প্রচার করা হলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এবং বাংলাদেশের জনগনের মধ্যে সচেতনতা এবং ঐক্য সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। আরাকান আর্মির নির্যাতন পর্যবেক্ষণ করা, মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নকে মূলধারায় স্বীকৃতি দেওয়া, উচ্চশিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ করা এবং প্রত্যাবাসন–পরিকল্পনায় রোহিঙ্গাদের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাশা। মিডিয়াকে এই সংকট বিষয়ক ঘটনাবলীর নিখুঁত ও বাস্তব উপস্থাপন চলমান রাখতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে যে, রোহিঙ্গাদের দাবীগুলো যেন সংকট সমাধানের মূল জায়গাগুলোতে পৌঁছাতে পারে।
রোহিঙ্গা সংকট কেবল বাংলাদেশের দায়িত্ব নয়, এটি একটি বৈশ্বিক সংকট। বাংলাদেশ তার মানবিক দায়িত্ব পালন করেছে, এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সক্রিয় ভূমিকা পালন করা। নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত নিয়মিত ভাবে এই সংকট এবং সমাধান সংক্রান্ত তথ্য উপাত্ত উপস্থাপনের কাজ চলমান রাখতে হবে। জনমত গঠন ও জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি এবং আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ গ্রহনে গণমাধ্যম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারে। নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং এর আইনগত ভিত্তি ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে এই সংকটকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তুলে ধরতে হবে। মিডিয়াতে শুধু মানবিক সহায়তা, প্রত্যাবাসনে অনিশ্চয়তা কিংবা নিরাপত্তা সংক্রান্ত তথ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে চলমান বাস্তবতা ও সংকটের সম্ভাব্য সমাধান বিশ্বকে জানাতে হবে যাতে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ও বৈশ্বিক আলোচনায় সেগুলো সরাসরি প্রভাব ফেলে এবং সংকট সমাধানকে ত্বরান্বিত করে।
লেখক: মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক।
আমার বার্তা/ব্রি. জে. (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন/এমই