ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও এক ব্যক্তির হাতে যাতে ক্ষমতা কেন্দ্রভূত না হয়, সেই বিধানগুলো সংবিধানে যুক্ত করার প্রস্তাব বিবেচনা করছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। সামগ্রিকভাবে ক্ষমতা ভারসাম্য নিশ্চিতেই জোর দিচ্ছে এই কমিশন।
দেশের প্রধান দুটি দৈনিকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন কমিশনের প্রধান ড. আলী রিয়াজ।
সংবাদ মাধ্যমকে তিনি জানিয়েছেন, ৭ জানুয়ারি শেষ হবে সংবিধান সংস্কারবিষয়ক কমিশনের কার্যকালের মেয়াদ। ওয়েবসাইট ও খানা জরিপের মাধ্যমে কমিশনের কাছে ৯৬ হাজারের বেশি মতামত এসেছে। এসব সুপারিশে ক্ষমতার ভারসাম্য এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পক্ষেই সবচেয়ে বেশি মতামত এসেছে, জানিয়েছেন ড. রিয়াজ।
নির্ধারিত সময়ে কমিশনের প্রতিবেদন দেওয়া কি সম্ভব হবে কিনা-এমন প্রশ্নে কমিশন প্রধান বলেন, ‘বাড়তি সময়ের দরকার হবে না। আমাদের কাজ হলো সংবিধান পর্যালোচনা, সারাংশ নির্ধারণ ও যৌক্তিক কিছু সুপারিশ তৈরি করা। পর্যালোচনা শেষ করে এরই মধ্যে আমরা সুপারিশ লেখা শুরু করেছি। আশা করছি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই আমরা কাজ শেষ করতে পারব। ৭ জানুয়ারি সরকারের কাছে জমা দেওয়ার সর্বাত্মক প্রস্তুতি চলছে।’
অংশীজনদের মতামত গ্রহণে কিভাবে কাজ করেছে সংস্কার কমিশন-প্রশ্ন ছিল কমিশন প্রধানের কাছে। এ প্রসঙ্গে আলী রিয়াজ বলেন, ‘কমিশনের ওয়েবসাইটে গত ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত মোট ৫০ হাজার ৫৭৩ জন মতামত দিয়েছেন। গত ৫ থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে এ বিষয়ে খানা জরিপ পরিচালিত হয়। তাতে মতামত দিয়েছেন ৪৫ হাজার ৯২৪ জন। ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৫টি রাজনৈতিক দল এবং ৩টি রাজনৈতিক জোটের মতামত এসেছে। ৭ জন সংবিধান বিশেষজ্ঞ, ৪৩টি সংগঠনের অংশীজন, ১০ তরুণ চিন্তাবিদের সঙ্গে সভা করে মতামত নিয়েছি।’
কমিশনের সুপারিশমালার অগ্রাধিকার নিয়ে তিনি বলেন, ‘অংশীজনদের মতামত প্রাধান্য দিয়ে আমরা গণতান্ত্রিক ও নাগরিকের অধিকার সুরক্ষা হবে এমন কিছু বিষয়কে সংস্কারে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। তার মধ্যে রয়েছে- ক্ষমতার ভারসাম্য, পঞ্চদশ সংশোধনী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা, আনুপাতিক হারে ভোটের বিধান দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ চালু, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শাসনকাল, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানো, বাহাত্তরের সংবিধান, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ, স্থানীয় সরকারব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ ও ক্ষমতায়ন, গণভোট প্রভৃতি।’
‘বিশেষ করে সংসদ সদস্যদের সর্বোচ্চ বয়সসীমা কমিয়ে আনার পক্ষে আমাদের সুপারিশ থাকবে। কারণ কমিশন মনে করে, বর্তমান বাংলাদেশে সংসদে তরুণদের প্রতিনিধিত্ব বাড়ানো প্রয়োজন। তারা যাতে সংসদে তরুণ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। এ জন্য তরুণদের প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর পক্ষে মত দেব’-যোগ করেন কমিশন প্রধান।
বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু নিয়ে কমিশনের অবস্থান ব্যাখ্যা করে আলী রিয়াজ বলেন, ‘অতীতে এ দেশে দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কোনো নজির আমরা দেখিনি। সেগুলোতে জনমতের কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। প্রতিটিতে অগণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতাসীন দলই বিজয়ী হয়েছে। কাজেই দেশের ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করতে আমি মনে করি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিকল্প নেই।’
সংবিধান পুনর্লিখন নাকি পরিমার্জন-কোন পথে এগুচ্ছে কমিশন, এমন প্রশ্নে আলী রিয়াজ বলেন, ‘সেটা আমাদের আওতার মধ্যে পড়ে না, সংবিধানের খসড়া আমরা তৈরি করছি না। সেটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। কাজেই কমিশন সে বিষয়ে সুপারিশও দেবে না। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে সংবিধান পর্যালোচনা, সারাংশ নির্ধারণ ও যৌক্তিক কিছু সুপারিশ তৈরি করা। আমরা সেই সব সুপারিশ সরকারকে দেব। আমাদের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। পরে সরকার রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে তারা সংবিধান পুনর্লিখন করবেন না সংযোজন-বিয়োজন করে সংশোধনী এনে সংকট সমাধানের পথ খুঁজবেন, অগ্রসর হবেন- সেটা তাদের সিদ্ধান্ত।’
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানকে (১৯৭২ সালে প্রণীত) ‘ত্রুটিপূর্ণ’ উল্লেখ করে সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, ‘জরুরি অবস্থার সময় যেভাবে গণপরিষদ তৈরি করা হয়েছিল, তা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। বেশির ভাগ প্রতিনিধিত্ব ছিল একটি দলের। মাত্র তিনজন ছিলেন অন্য দলের। ফলে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মতের প্রতিফলন তাতে ছিল না। এ ছাড়া কন্টেন্টের দিক থেকেও বাহাত্তরের সংবিধানের নাগরিকদের অধিকার সংকুচিত করা হয়েছে।’
আমার বার্তা/এমই