দেশের মানুষ জীবন রক্ষাকারী ওষুধ সেবন করতে গিয়ে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ওষুধ প্রশাসনের অসাধু চক্র রহস্যজনক কারণে বাজার থেকে নকল ওষুধ জব্দ করার কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না গত কয়েক মাস ধরে।
অভিযোগকারীরা বলছেন, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর এখন দুর্নীতিবাজদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। মোটা অংকের ঘুষ ছাড়া কোনো ফাইল নড়ে না। ভুক্তভোগীরা বলছেন, মাসের পর মাস ঘুরেও তারা প্রয়োজনীয় ফাইলে অনুমোদন নিতে পারছেন না। অন্যদিকে নকল ওষুধ তৈরি কারখানাগুলোর মালিকদের সাথে সরাসরি জড়িত রয়েছে সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
ফলে বন্ধ হচ্ছে না নকল ওষুধ তৈরি। অভিযোগ রয়েছে, দেশের নামি-দামি ওষুধ কোম্পানির বহুল প্রচলিত বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ওষুধ নকল করে ওষুধের নাম ও গেটআপ হুবহু লিখে নকল ওষুধ বাজারে বিক্রি করছে। এই ভয়ঙ্কর অপরাধমূলক কাজে সরাসরি সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে কিছু অসাধু কর্মকর্তা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা জানান, ডিজির ছত্রছায়ায় পরিচালক সালাউদ্দিন, পরিচালক আকিব হোসেন, পরিচালক আশরাফ হোসেন ঘুষ বাণিজ্যে জড়িত রয়েছেন। তাদের অনিয়ম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মতো কেউ নেই। কারণ মহাপরিচালকের আশীর্বাদ রয়েছে ওই অসাধু দুর্নীতিবাজ চক্রের প্রতি। তাদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক) মামলা চলমান রয়েছে।
অবৈধ ও নকল ওষুধ তৈরি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা নিয়ে তাদের অনৈতিক কাজে সহযোগিতা দিচ্ছেন ওইসব কর্মকর্তাবৃন্দ। ওই সিন্ডিকেটের কর্মকর্তাদের কেউ কেউ ১৫ থেকে ২০ বছর ধরে স্বপদে বহাল থেকে ঘুষ বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরে প্রতিটি ধাপে অনৈতিক আর্থিক লেনদেন হচ্ছে। ওষুধের লাইসেন্স দেয়া থেকে শুরু করে লাইসেন্স নবায়ন পর্যন্ত ১৩ খাতে ৫০০ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়মবহির্ভূত অর্থ বা ঘুষ আদায় হয় বলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, ওষুধ নিবন্ধন, নমুনা পরীক্ষা, মান নিয়ন্ত্রণ, রপ্তানি নিবন্ধনসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে প্রতিষ্ঠানটিতে সীমাহীন ঘুষ-বাণিজ্য চলছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, অভিযোগ সত্য নয়। নকল ওষুধ তৈরিকারী চক্রের সাথে সংস্থার কেউ জড়িত নয়। আমরা নকল ও ভেজাল ওষুধ তৈরি ও বাজারজাতকারীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় ব্যবস্থা নিয়ে আসছি।
জানতে চাইলে পরিচালক সালাউদ্দিন বলেন, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকলে কি করে ফাইলে অনুমোদন দেয়া হবে। ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ ভিত্তিহীন, মিথ্যা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গবেষণায় ওষুধ প্রশাসনের আওতাধীন অ্যালোপ্যাথি, ইউনানি, আয়ুর্বেদিক, হোমিওপ্যাথি ও হারবাল এই পাঁচ শ্রেণির ওষুধের বাজার তদারকি ও নিয়ন্ত্রণে সমস্যা, অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে বিভিন্ন সময়ের প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এখানে নতুন ওষুধের লাইসেন্স দেয়া থেকে শুরু করে ড্রাগ লাইসেন্স নবায়ন পর্যন্ত ১৩ খাতে পাঁচশ’ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থ আদায় করা হয়। এছাড়া অধিদপ্তরের কার্যক্রম পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব, অরগানোগ্রাম অনুযায়ী দায়িত্ব বণ্টন না করা, সেবা কার্যক্রমের প্রতিটি পর্যায়ে যোগসাজশের মাধ্যমে দুর্নীতি করা হচ্ছে।
ওষুধ প্রশাসনের অনিয়ম, দুর্নীতি সংক্রান্ত একাধিক প্রতিবেদন বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও টিআইবি সংশ্লিষ্ট মহলে পেশ করেছেন। তারপরেও ওই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।
অভিযোগ রয়েছে, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরে সদর দপ্তরে কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। তাদের ঘুষ বাণিজ্যের নেটওয়ার্ক দেশব্যাপী। ফাইল আটক করে মোটা অংকের টাকা আদায় ও হয়রানি করার ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। ওই সংস্থাটির পরিচালক সালাউদ্দিন, ইয়াহিয়াসহ ৫ জন পরিচালক দীর্ঘ ১০ থেকে ১২ বছর ধরে একই স্থানে কর্মরত রয়েছেন।
সদর দপ্তরে দীর্ঘদিন বহাল তবিয়তে থাকার সুবাদে শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। বিধি অনুযায়ী একজন পরিচালক একই স্থানে সর্বাধিক ৩ বছরের অধিক সময় থাকতে পারেন না। কিন্তু কেউ কেউ ৫ থেকে ১০ বছর একই স্থানে বহাল রয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, ওষুধের ফয়েল, ইনসার্ট, লেবেল, মোড়ক, ব্লকলিস্ট ও লিটারেচার অনুমোদন, ওষুধের দোকান তদারকি ও পরিদর্শনে কর্মকর্তারা ব্যাপক আর্থিক লেনদেন করেন।
এছাড়া কিছু কোম্পানি ওষুধ তৈরিতে বিভিন্ন ফার্মাকোপিয়া অনুসরণ না করে ফয়েলে বিপি ও ইউএসপি উল্লেখ করে। কিছু কোম্পানি ওষুধের ব্লকলিস্ট অনুমোদনে প্রভাব বিস্তার এবং বিদেশে রপ্তানিতে উন্নতমানের ও স্থানীয় বাজারে বিপণনে নিম্নমানের কাঁচামাল ব্যবহার করে।
এদিকে টিআইবির এ প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. ইয়াহিয়া বলেন, প্রতিবেদনটি এখনও তাদের হাতে পৌঁছেনি। প্রতিবেদনটি দেখার পর ওষুধ প্রশাসনের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেয়া হবে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, গবেষণার বিভিন্ন পর্যায়ে তারা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং প্রতিবেদন চূড়ান্ত হওয়ার পর অধিদপ্তরকে দেখিয়েছেন। তিনি বলেন, নিয়মবহির্ভূত অর্থ আদায়ের বিষয়টি ওষুধ প্রশাসন স্বীকার করে নিলেও টাকার অংকের সঙ্গে তারা একমত হননি।
টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, অধিদপ্তরে দায়িত্বশীলতার অভাব রয়েছে। যার যে কাজ করা দরকার, তারা সেই কাজ করছেন না বা করতে পারছেন না।
জানা যায়, বাংলাদেশে বর্তমানে ২৫৭টি কারখানায় প্রায় ২৪,০০০ ব্র্যান্ডের ওষুধ উৎপাদন হচ্ছে। দেশীয় কোম্পানিগুলো বছরে প্রায় ২৫,০০০ কোটি টাকার ওষুধ ও কাঁচামাল তৈরি করছে। এতে করে ২ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি দেশের প্রায় ৯৮ শতাংশ ওষুধের চাহিদা পূরণ করছে দেশীয় কোম্পানিগুলো।
তাছাড়াও, দেশের অর্থনীতিতে রাখছে বিরাট ভূমিকা। বাংলাদেশের উৎপাদিত ওষুধ যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের প্রায় ১৪৫টি দেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। বাংলাদেশের উৎপাদিত ওষুধের চাহিদা ও ব্যবহার বিশ্ববাজারে বেড়েই চলেছে।
বিশ্ববাজারে যখন বাংলাদেশে উৎপাদিত ওষুধের চাহিদা বেড়ে চলেছে ঠিক তখনই এর বিপরীত চিত্র দেশের ওষুধের বাজারে। দেশীয় বাজারে উৎপাদিত হচ্ছে ভেজাল ও নকল ওষুধ, যার ফলে ক্রমশই অস্থির হয়ে উঠছে ওষুধ শিল্প ও চিকিৎসা ব্যবস্থা। ভেজাল ও নকল ওষুধ এই শিল্পের উন্নয়ন ও প্রসারে এক বিরাট অশনি সংকেত। পরিসংখ্যান মতে, দেশীয় বাজারে ভেজাল ও নকল ওষুধের বার্ষিক বিক্রি প্রায় ১.৫ হাজার কোটি টাকার উপর।
জানতে চাইলে পরিচালক আশরাফ হোসেন বলেন, এসব বিষয়ে কোনো কথা বলতে পারবো না। মহাপরিচালকের সাথে কথা বলতে তিনি পরামর্শ দেন।
বিরাট অংকের ভেজাল ওষুধের বিক্রি থেকে সহজে অনুমান করা যায়, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের উৎপাদিত ওষুধের সুনাম থাকলেও দেশীয় বাজারে চলছে চরম অনিয়ম ও দুর্নীতি। এসব ভেজাল ও নকল ওষুধ বাণিজ্যের ফলে সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ছে। ভেজাল ওষুধের ফলে রোগীর স্বাস্থ্যঝুঁকি ও প্রাণহানির ঘটনাও ক্রমশ বেড়ে চলেছে।
দেশে নকল ওষুধ তৈরি হচ্ছে বেশ কয়েকটি বৈধ কারখানায়। রাজধানীর মিটফোর্ডকেন্দ্রিক একটি মুনাফালোভী চক্র ওষুধ ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে তা ছড়িয়ে দিচ্ছে প্রত্যন্ত গ্রাম-গঞ্জে। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর অনুমোদিত ৭৯টি ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক কারখানায় বিভিন্ন নামি-দামি অ্যালোপ্যাথিক কোম্পানির ওষুধ নকল করা হয়। আবার এসব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন পরিবেশ দেখে সন্দেহ জাগে এত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এরা অনুমোদন পেল কিভাবে?
নিজস্ব অনুসন্ধানেও উঠে এসেছে এমন ভেজাল ও অনুমোদনহীন অসংখ্য কারখানার সন্ধান। যাদের কারো বা আংশিক অনুমোদনও রয়েছে। কারো বা মেয়াদ নেই কিন্তু উৎপাদনও থেমে নেই। অনেকের আবার অনুমোদন একনামে উৎপাদন হচ্ছে অন্য নামে।
গোয়েন্দা সংস্থা ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা সরবরাহ করেছে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কাছে। ডিবি পুলিশ জানিয়েছে, দেশীয় ওষুধের পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠানে নকল করা হচ্ছে বিদেশি নামিদামি ওষুধও। এগুলো উৎপাদন ও বিপণনের কাজে জড়িত একাধিক সংঘবদ্ধ চক্র।
আর নকল ওষুধ বিপণনের বড় হাট রাজধানীর মিটফোর্ড। এখান থেকেই অসাধু চক্র কুরিয়ারের মাধ্যমে নকল ওষুধের চালান পাঠিয়ে দেয় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ফার্মেসি মালিকদের কাছে। অধিক লাভের আশায় জেনেশুনেই ফার্মেসি মালিকরা তা কিনে নিচ্ছে।
এদিকে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের এবং মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রির বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ২ হাজার ৪৫০টি মামলা করা হয়েছে। জরিমানা আদায় করা হয়েছে ২ কোটি ৬৭ লাখ ৫৪ হাজার ৩০০ টাকা।
ডিবি পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, হুবহু ‘আসল’ মোড়কে গ্যাস্ট্রিক, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, কিডনি রোগসহ বিভিন্ন জটিল রোগের নকল ওষুধ বাজারে ছাড়ছে সংঘবদ্ধ চক্র, যা দেখে ভোক্তাদের আসল-নকল পরখ করা অনেকটাই দুঃসাধ্য। তথ্য রয়েছে, এ চক্রকে সহযোগিতা করছে অতি মুনাফালোভী কতিপয় ফার্মেসি মালিক।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, বৈধ বিভিন্ন ইউনানি আয়ুর্বেদিক ওষুধ কারখানায় তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন নামি-দামি কোম্পানির বহুল ব্যবহৃত নকল ওষুধ। আটা, ময়দা, রং ও ঘন চিনি মিশিয়ে তৈরি করা হচ্ছে এসব নকল ওষুধ। পরে তা ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে অলিগলিসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ফার্মেসিগুলোয়, যা রোগ সারানোর বদলে ভোক্তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন কোম্পানির কারখানা পরিদর্শনের নামে তাদের পছন্দের কর্মকর্তাদের দিয়ে পরিদর্শন টিম গঠন করেন। এসব টিমে যাদের সংযুক্ত করা হয় তারা পরিদর্শনের নামে লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য করছেন সারা বছরই।
এবি/ওজি