মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে হামাসকে রাজি করাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে তুরস্ক। এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে প্রভাব প্রতিষ্ঠার সুযোগ পেয়েছেন প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান। এটি ইসরায়েল ও আরব প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছে। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে এসব কথা উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুরুতে ট্রাম্পের আলটিমেটাম মানতে অনিচ্ছুক ছিল হামাস। কিন্তু তুরস্কের আহ্বানে তারা অবশেষে রাজি হয়। ট্রাম্প নিজেই বলেছেন, তুরস্ক নামের একটি জায়গা থেকে আসা এই ভদ্রলোক বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী নেতা। এরদোয়ান একজন নির্ভরযোগ্য মিত্র। আমি যখনই তাকে ডাকি, তিনি সাড়া দেন।
এই চুক্তিতে স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে এরদোয়ান মধ্যপ্রাচ্যের কূটনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আবারও মূল ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন। এর ফলে তুরস্ক এখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে স্থগিত থাকা একাধিক বিষয়ে সুবিধা নিতে চাইছে। যেমন এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান বিক্রির পুনরায় অনুমোদন, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও সিরিয়ায় তুরস্কের নিরাপত্তা লক্ষ্য বাস্তবায়নে সহযোগিতা।
ইস্তাম্বুলভিত্তিক থিংক ট্যাংক ইডিএএমের পরিচালক সিনান উলগেন বলেন, হামাসকে ট্রাম্পের গাজা চুক্তিতে রাজি করানো আঙ্কারাকে নতুন কূটনৈতিক প্রভাব দিয়েছে। এখন তুরস্ক এই সদিচ্ছাকে কাজে লাগিয়ে ওয়াশিংটনের সঙ্গে পুরোনো মতপার্থক্য মেটাতে পারবে।
এরদোয়ান ও ট্রাম্পের মধ্যে কূটনৈতিক পুনর্বিন্যাস শুরু হয় গত সেপ্টেম্বরের ওয়াশিংটন বৈঠকে। ছয় বছর পর সেটি ছিল এরদোয়ানের প্রথম হোয়াইট হাউজ সফর। সেখানে আলোচনায় উঠে আসে একাধিক অমীমাংসিত ইস্যু। বিশেষ করে ২০২০ সালে রুশ এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র কেনার পর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা ও তুরস্কের এফ-৩৫ প্রকল্প থেকে বাদ পড়া।
সিরিয়া প্রসঙ্গেও আলোচনা হয়। আঙ্কারা চায়, মার্কিন সমর্থিত কুর্দি গোষ্ঠী সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস (এসডিএফ) যেন সিরীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে একীভূত হয়। তুরস্কের দৃষ্টিতে এসডিএফ হলো ‘সন্ত্রাসী সংগঠন পিকেকে’-র সহযোগী। এসডিএফ প্রধান মাজলুম আবদি ইতোমধ্যে এই একীভূতকরণের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। যা তুরস্কের জন্য বড় কূটনৈতিক জয়।
গাজা চুক্তির মধ্য দিয়ে তুরস্ক আবারও আঞ্চলিক প্রভাবের কেন্দ্রবিন্দুতে ফিরেছে। এরদোয়ানের প্রশংসা আগেও করেছিলেন ট্রাম্প। রাশিয়া-ইউক্রেন আলোচনার আয়োজন ও সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের পতনের পর মধ্যপ্রাচ্যে আঙ্কারার ভূমিকার জন্য তুর্কি প্রেসিডেন্ট প্রশংসা পেয়েছিলেন ট্রাম্পের।
তবে এই উত্থান ইসরায়েল ও কয়েকটি আরব রাষ্ট্রের কাছে অস্বস্তিকর। মিসর, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের কর্মকর্তারা মনে করেন, এরদোয়ানের নেতৃত্বে তুরস্কের বাড়তি ভূমিকা তাদের জন্য কৌশলগত চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।
আরব রাজনৈতিক বিশ্লেষক আয়মান আবদেল নূর বলেন, এরদোয়ান সুযোগ কাজে লাগাতে ও পরিস্থিতি নিজের পক্ষে ঘুরিয়ে নিতে পটু। উপসাগরীয় আরব দেশগুলো খুশি না হলেও তারা চেয়েছিল যুদ্ধ শেষ হোক এবং হামাস দুর্বল হোক।
লেবানিজ বিশ্লেষক সারকিস নাউম বলেন, অটোমান আমলে তুরস্ক যেভাবে আরব অঞ্চল শাসন করেছিল, বর্তমান ভূমিকায় সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
হামাসের উদ্বেগ রয়ে গেছে। ইসরায়েল চুক্তি ভঙ্গ করে পুনরায় সামরিক অভিযান শুরু করতে পারে। এক সিনিয়র হামাস কর্মকর্তা বলেন, আমাদের আসল নিশ্চয়তা এসেছিল চার পক্ষ থেকে-তুরস্ক, কাতার, মিসর ও যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্প নিজে গ্যারান্টি দিয়েছেন যে, জিম্মি মুক্তির পর যুদ্ধ আর শুরু হবে না।
ইসরায়েলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক কোনও মন্তব্য করেনি। তবে কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ইসরায়েল প্রথমে তুরস্কের অংশগ্রহণে আপত্তি জানিয়েছিল, পরে ট্রাম্পের চাপের মুখে রাজি হয়।
এরদোয়ান বলেছেন, বর্তমান অগ্রাধিকার হলো পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতি, মানবিক সহায়তা ও গাজা পুনর্গঠন। পরবর্তী ধাপে নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
যুদ্ধবিরতি চুক্তি যদিও অবরুদ্ধ গাজায় ত্রাণ ও পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার পথ খুলে দিয়েছে, তবু এটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে কোনও রূপরেখা দেয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। তুরস্ক, কাতার ও মিসরসহ বেশ কিছু আরব দেশ বলছে, এই পরিকল্পনা ‘দুই রাষ্ট্র সমাধান’-এর দাবিকে উপেক্ষা করেছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় ১ হাজার ২০০ ইসরায়েলি নিহত হওয়ার পর ইসরায়েলের প্রতিশোধমূলক অভিযানে এখন পর্যন্ত ৬৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে বলে গাজা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
আমার বার্তা/এমই