আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ের তিন সংসদ নির্বাচন ঘিরে অভিযোগ পর্যালোচনা এবং নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্টদের ভূমিকা বিশ্লেষণের জন্য গত জুন মাসে পাঁচ সদস্যের যে কমিটি করা হয়েছিল, ক্ষমতা বাড়িয়ে তাকে কমিশনে রূপান্তর করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আব্দুর রশীদ স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, কমিশনকে আগামী ৩১ অক্টোবরের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন ও সুপারিশ জমা দিতে হবে।
২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচন পর্যালোচনার জন্য গত ২৬ জুন এই কমিটি করেছিল সরকার।
নতুন প্রজ্ঞাপনের বিষয়ে প্রশ্ন করলে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের একান্ত সচিব জয়নাল আবদিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগের কমিটিকে আরও শক্তিশালী আইনি ভিত্তি দেওয়ার জন্য কমিশনে রূপান্তর করা হয়েছে। বাকি বিষয়গুলো আগের মতই আছে।”
হাই কোর্ট বিভাগের সাবেক বিচারপতি শামীম হাসনাইনকে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচন পর্যালোচনার জন্য গঠিত এই কমিশনের সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া সরকারের সাবেক গ্রেড-১ কর্মকর্তা শামীম আল মামুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মাহফুজুল হক (সুপণ), ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের আইনজীবী ব্যারিস্টার তাজরিয়ান আকরাম হোসাইন এবং নির্বাচন বিশ্লেষক মো. আব্দুল আলীম সদস্য হিসেবে এই কমিশনে থাকছেন।
এই কমিশন গঠনের কারণ ব্যাখ্যা করে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, “বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ২০১৪, ১৮ ও ২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। এসব নির্বাচনে নানা কৌশলে জনগণের ভোটাধিকার খর্ব করে একটি বিশেষ দলকে নির্বাচিত করার অভিযোগ রয়েছে।
“এরই প্রেক্ষাপটে উত্থাপিত অভিযোগগুলো পর্যালোচনার মাধ্যমে ভবিষ্যতে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে করণীয় নির্ধারণ করতে সরকার নিম্নরূপে একটি কমিশন গঠন করছে।”
কমিশনের কার্যপরিধি
● ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিষয়ে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক, নাগরিক সংগঠন, তদারকি প্রতিষ্ঠান এবং গণমাধ্যমে উত্থাপিত অভিযোগ বিশ্লেষণ;
● নির্বাচনে দুর্নীতি, অনিয়ম ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ এবং এর নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত পর্যালোচনা;
● তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের ভূমিকা ও রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি সংক্রান্ত অভিযোগ বিশ্লেষণ;
● নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সকল সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার ভূমিকা পর্যালোচনা;
● আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকা বিশ্লেষণ;
● তৎকালীন নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ যাচাই ও অনুসন্ধান;
● নির্বাচন অনিয়মের দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ;
● ভবিষ্যতে সুষ্ঠু ও মানসম্পন্ন নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সুপারিশ প্রণয়ন;
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, কমিশন দেশের যে কোনো স্থান পরিদর্শন, যে কোনো সরকারি দপ্তরের নথি তলব এবং সন্দেহভাজন যেকোনো ব্যক্তিকে তলব ও জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কমিশনকে সাচিবিক সহায়তা এবং বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন লজিস্টিক ও তথ্য সহায়তা দেবে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। সে অনুযায়ী ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা হয় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়।
এর মধ্যে দশম ও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের নির্দলীয় সরকারের দাবি পূরণ না হওয়ায় নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপিসহ বেশিরভাগ বিরোধী রাজনৈতিক দল।
তাদের বর্জনের ফলে দশম নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য হয়ে যান। সেই সংসদকে ‘বিনা ভোটের সংসদ’ আখ্যা দেয় ভোট বর্জন করা বিএনপি।
বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর একটি অংশ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিলেও ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ উঠে। অধিকাংশ ভোট আগের রাতে হয়ে যাওয়ার অভিযোগের মধ্যে বিরোধীরা মাত্র সাতটি আসনে জয় পায়। সে নির্বাচনের নাম হয় ‘নীশিরাতের নির্বাচন’।
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে বিএনপি ও সমমনাদের বর্জনে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক দেখাতে শরিক ও বিরোধীদল জাতীয় পার্টির জন্য আসন ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের সঙ্গে দলের বিদ্রোহীদের। এ নির্বাচনের নাম হয় ‘আমি আর ডামি’ নির্বাচন।
প্রশ্নবিদ্ধ ওই তিন নির্বাচনেই আওয়ামী লীগ জয়ী হয় এবং ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে দেশ শাসন করে যায়। শেষ পর্যন্ত ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটে।
গতবছর ডিসেম্বরে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আংশিক বাতিল করে রায় দেয় হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ। তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরানোর পথ তৈরি হয়।
অবাধ ও নিরপেক্ষতা ‘নিশ্চিত করতে না পারায়’ আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত তিন জাতীয় নির্বাচনে ‘জনগণের আস্থা ধ্বংস করা হয়েছে’ বলে পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয় ওই রায়ে।
২০১৪ সালের নির্বাচনে সিইসি ছিলেন কাজী রকিব উদ্দিন আহমদ, ২০১৮ সালে কে এম নূরুল হুদা এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনে ছিলেন কাজী হাবিবুল আউয়াল।
‘জনগণের ভোট ছাড়া’ ওই নির্বাচনগুলো আয়োজনের অভিযোগে গত জুন মাসে একটি মামলাও করেছে বিএনপি। ওই তিন নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা নির্বাচন কমিশনের সব পদাধিকারীর পাশাপাশি ক্ষমতচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আসামি করা হয়েছে সেখানে। কে এম নূরুল হুদা ও কাজী হাবিবুল আউয়ালকে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।
আমার বার্তা/জেএইচ