দক্ষিণ এশিয়ায় বৃহত্তম রাষ্ট্র ভারত। প্রায় ২৮টি রাজ্য নিয়ে গঠিত এই দেশ। এই দেশে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠী, বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও বহু ভাষাভাষী লোক বসবাস করে। এই দেশটি আয়াতনে বড় হলেও দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে আঞ্চলিক নেতাসহ বেশির ভাগ মানুষের মনমানসিকতা নিম্নশ্রেণির মানুষের মতো। যে মানসিকতায় মনুষ্যত্ববোধের পচন ধরছে এবং সে মনুষ্যত্ব তাদের থেকে দূরতম দারুচিনি দ্বীপ এ পলায়ন করছে। যেটা মানুষকে নিজ ধর্ম ও জাত, গোষ্ঠী ব্যতীত অন্যকে দুই চোখে সহ্য করতে পারে না। বিভিন্ন কুচক্র ও অপরাধের নাটক করে নিজ জাতির বাহিরের অন্য জাতিকে মেরে ফেলতেও দ্বিতীয়বার ভাবে না। এই যেন জানোয়ার জন্তুর স্বভাব।
বর্তমান যুগ হলো আধুনিক যুগ। যে সময়ে মানুষের জীবন যাত্রা মান উন্নত করার পাশাপাশি, মানুষের চিন্তা চেতনায় উন্নত হওয়া এবং মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা উচিত ছিল। একে অপরের সাথে মিলেমিশে থাকার কথা ছিল, নিজ জাতিগোষ্ঠীর বাহিরে অন্য জাতি গোষ্ঠী মানুষের কল্যাণের কথা মনে লালন করার উচিত ছিল। কিন্তু না, আধুনিকতার নামে দিন দিন মানুষের বিবেক বুদ্ধি লোপ পাচ্ছে, মানুষের মনের মধ্যে হিংসা বিদ্বেষ বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্য জাতিকে নির্মূল করার পায়তারা করছে, মনুষ্যত্ববোধ লোপ পাওয়ার সাথে সাথে মানুষকে পশুর সমতুল্য গড়ে তুলছে, মানুষকে মেরে ফেলতেও দ্বিধাবোধ করে না। এ কেমন আধুনিকতা? এ কেমন সভ্যতা? এ কেমন অসাম্প্রদায়িকতা?
আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র মহাভারত। যারা সর্বদা সংখ্যালঘু নিয়ে চিন্তা করে। যারা মানবাধিকার নিয়ে প্রায় বুলি আওড়ায়। এসব বিষয়ে ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের পর বাংলাদেশকে একটু বেশিই উপদেশ দিতো। যেন এটা নিয়ে তারা খুব উদ্বিগ্ন। মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি। কিন্তু নিজের দেশের ব্যাপারে চিত্রটা একদম ভিন্ন। ভারতে ১৪২ কোটি জনগণের মধ্যে মুসলমান মাত্র ২০.৫ কোটি যেটা মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৭.৭%। তারা তাদের দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সংখ্যালঘু মুসলমান জাতিকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপায়ে কুক্ষিগত করার চেষ্টা করে, তাদের উপর নির্যাতনের ষ্টীম রোলার চালানো হয়। এই যেন চোরের মুখে ধর্মের বাণী।
২০১৪ সালে ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে মুসলমানদের উপর বিভিন্ন ধরনের হয়রানি ও নির্যাতন এবং অত্যাচার করার পায়তারা করছে। চলছে মুসলমান জাতিকে টার্গেট করে বিভিন্ন আইন প্রনয়ণ, যাতে এই জাতিকে কোণঠাসা করে রাখা যায়। মুসলমান কোনো গরু জবাই করতে পারবে না, তারা গরু মাংস খেতে পারবে না। যদি গরু মাংস বিক্রি বা খেতে দেখা গেলে বা মুসলিম হোস্টেল এ গরু গোস্ত রাখলে তাদেরকে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করে। শুধু এখানেই ক্ষ্যান্ত নয়, কোনো মুসলিম নারী হিজাব পরা অবস্থায় দেখলে তাদের মাথা থেকে হিজাব খুলে ফেলে বা তাদেরকে বিভিন্নভাবে উত্যক্ত করে। এর সাথে উগ্র হিন্দুবাদিরা কোনো বাচ্চা বা বৃদ্ধকে জোর করে মুখ দিয়ে "জয় শ্রী" রাম বলতে বাধ্য করে। এগুলো করার ক্ষেত্রে আবার সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা থাকে। এগুলো কি কোনো অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের কাজ হতে পারে?
এই তো কিছুদিন পূর্বে চলতি মাসে শুরুতে ভারতের পার্লামেন্ট এ একটা বিতর্কিত আইন পাশ করে। যেটা ছিল মুসলমানদের ওয়াকফকৃত জায়গা নিয়ে। মুসলমানরা তারা তাদের জমি থেকে আল্লাহর নামে ধর্মীয় বা জনহিতকর কাজের জন্য মুসলিম আইন অনুসারে দানকৃত স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি দান করে। এগুলো কারোর নামে মালিকানায় থাকে না। কিন্ত বর্তমান ওয়াকফ বিলে ওয়াকফকৃত জায়গাতে দু’জন হিন্দু সদস্য রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। মুসলমানদের মধ্যে দু’জন নারী সদস্য, যারা বিধবা, বিবাহ বিচ্ছিন্ন বা অনাথ হবেন। মুসলমান সদস্য কেবল তিনি হতে পারবেন, যিনি ৫ বছর ইসলাম পালন করেছেন ওয়াকফে দানের অধিকার কেবল তারই থাকবে। যদি এর ঠিক উল্টো চিত্রটা আমরা চিত্রায়ণ করি, ভারতে মন্দিরে মালিকানায় বা হিন্দু সম্পত্তির মালিকানায় কোনো মুসলমান থাকার আইন প্রনয়ণ করা হতো, তাহলে মনে হয় পুরো ভারত জুড়ে রক্ত গঙ্গায় ভেসে যেত। হিন্দু সম্প্রদায়ের সেই সম্পদের ব্যাপারে দুটো শব্দও ব্যয় করে আইন প্রনয়ণ করে নাই। তাহলে কেন মুসলমান জাতির ওয়াকফকৃত জায়গার উপর মোদি সরকার শকুনের চোখ পড়েছে। কারণটা বেশ সহজবোধ্য, ভারতে রেল ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পর সবচেয়ে বেশি স্থাবর সম্পত্তির মালিক ভারতীয় ‘ওয়াকফ বোর্ড’। আনুমানিক ৯ লাখ ৪০ হাজার একর জায়গা জুড়ে ৮ লাখ ৭০ হাজার সম্পত্তি রয়েছে তার হাতে। মোদি সরকার এই বিপুল সম্পত্তির দখল ও পরিচালনার ভার নিজের হাতে নিতে চায়। নিজ দেশে ভারতীয় মুসলিমদের কন্ঠরোধ করতে চায়, নিজ দেশেই তাদেরকে নির্বাসিত করতে চায়। তারা মুসলমান সম্প্রদায়কে নিঃশেষ করতে চায়। আর এই আইন পার্লামেন্ট এ পাশ হওয়ার পর, ভারতে অনেক জায়গায় মসজিদ, মাদ্রাসা, বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দিয়েছে এবং দিচ্ছে। এমন কি দেশের প্রাচীন দেওবন্দ মাদ্রাসাকে ১ লা মে এর মধ্যে খালি করে দেওয়ার জন্য সতর্কবার্তা দিয়েছে। যেটা অসাম্প্রদায়িক দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগাচ্ছে এবং সেটাকে আরো স্ফুলিঙ্গ করছে। এই ভাবেই হিন্দুত্ববাদী সরকার মুসলিম জাতির উপর অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার করছে। এর পাশাপাশি ভারতীয় মিডিয়া ট্রায়ালে স্বীকার মুসলমানরা, মিডিয়াগুলো তাদেরকে পাকিস্তান এজেন্ট, জঙ্গীবাদ, জিহাদী সহ বিভিন্ন ট্যাগিং এর মাধ্যমে বিশ্বে মঞ্চে অপপ্রচার করছে। আপনি কি বিশ্বাস করেন এগুলো কি সরকারের মদদ ছাড়া সম্ভব? এর পিছনে সরকারের কোনো পৃষ্ঠপোষকতা নেই?
বর্তমান বিশ্বে ইসরায়েল সবচেয়ে বর্বরোচিত হামলা চালাচ্ছে ফিলিস্তিন এ। যেখানে নারী,শিশু, বৃদ্ধা সহ সবাইকে নির্বিচারে বোমা মেরে হত্যা করছে। তা দেখেও মুসললিম দেশগুলো সহ মানবতার ফেরিওয়ালা দেশগুলো কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নিচ্ছে না তেমন অবদান রাখছে না এই গণহত্যা বন্ধের ব্যাপারে। মনে হচ্ছে মানবতা আত্মহত্যা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। এই দেশটা বিশ্বের নিকট ক্যান্সারে পরিণত হয়েছে এবং ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের নিকট তারা গুরু। তারা এই গণহত্যাকে সমর্থন করছে। শুধু সমর্থন না, তারা মুসলিম জাতির উপর হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। তাদের মধ্যে ইসরায়েলি মনোভাব ও আচরণ ফুটে উঠেছে। স্বভাব ও আচাণগত দিক থেকে উভয় জাতির মধ্যে বেশ মিল রয়েছে। সরকার ভারতীয় মুসলিম নিধনে আগ্রাসন প্রমাণ করেছে, পৃথিবীর বুকে যেন তারা আরেক ইসরায়েল।
ভারত যদি সত্যিকারের সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র না হয়ে থাকে, সত্যিকারে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়ে থাকে, তাহলে এসব বিতর্কিত আইন এবং মুসলমানদের উপর রাষ্ট্র এবং সামাজিক বৈষম্য অত্যাচার অনিয়ম বন্ধ করতে হবে। ভারতীয় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দিতে হবে এবং রাষ্ট্র ও সামাজিক অধিকার রক্ষা ভূমিকা পালন করতে হবে। হিন্দু যেমন ভারতীয় নাগরিক মুসলিমও ভারতের নগরিক। শুধু মুসলমান হওয়ার কারণে বিভিন্ন অত্যাচার, সামাজিক বৈষম্য ও ট্যাগিং দেওয়ার নামে অপরাজনীতি বন্ধ করতে হবে এবং সাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এর বিপরীত হলে ভারতীয় জমিনে বিশাল ও ভয়ংকর দাঙ্গা হওয়ার আশঙ্কা বেশি এবং অনেক রক্ত ঝড়বে। যেটা একজন প্রকৃত মনুষত্ববোধরা কখনো কামনা করে না। আমরা চাই এমন একটা শান্তিময় পৃথিবী, যেখানে বিভিন্ন ধরনের জাতি, বিভিন্ন ধর্মীয় মানুষ, বহু ভাষাভাষী লোক একে অপরের সাথে মিলেমিশে বসবাস করবো এবং একটা বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তুলবো।
লেখক : শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।